প্রফুল্ল চন্দ্র রায় Prafulla Chandra Roy Biography in Bengali

Prafulla Chandra Roy Biography in Bengali

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জীবনী (Prafulla Chandra Roy Biography): প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এমন একজন মানুষ যিনি কখনো বৈজ্ঞানিক, কখনো সাহিত্যিক আবার কখনো সমাজসংস্কারক। এক মানুষে অনেক বৈশিষ্ট্য।

জন্ম ২ আগস্ট, ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ।
জন্মস্থান রাড়ূলী পাইকগাছা খুলনা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি (বর্তমান বাংলাদেশ) ব্রিটিশ রাজ।
মৃত্যু ১৬ জুন ১৯৪৪ (বয়স ৮২)।
পিতা ও মাতা হরিশচন্দ্র রায় ও ভুবনমোহিনী দেবী।
পড়াশোনা বিদ্যাসাগর কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ কলকাতা, এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়।
পরিচিতির কারণ ভারতীয় রসায়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠাতা; ভারতীয় রাসায়নিক শিল্প প্রতিষ্ঠাতা।
পুরস্কার
১৯১২ Companion of the Order of the Indian Empire (সিআইই),
১৯১৯ নাইট ব্যাচেলর, ১৯০২ ফেলো অফ ক্যেমিক্যাল সোসাইটি (এফসিএস), 
১৯৩৫ ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য (এফএনআই),
১৯৪৩ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সের সদস্য (এফআইএএস)।

জন্ম

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট তৎকালীন যশোর জেলার (পরবর্তীকালে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলা) রাড়ুলি-কাটিপাড়া গ্রামে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেন।

পিতা ও মাতা

হরিশচন্দ্র রায় ও মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। হরিশ্চন্দ্র রায় ছিলেন স্থানীয় জমিদার।

শৈশব

বনেদি পরিবারের ছেলে হওয়ায় প্রফুল্লচন্দ্র ছোটবেলা থেকেই ছিলেন তুখোড়। সবদিকে তাঁর রয়েছে বিচক্ষণতা। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দ্‌ সংস্কৃত, আরবি-ফারসি এবং উর্দু ভাষায় কথা বলতে পারতেন। ছোটো থেকেই খুব দূরন্ত ছিলেন। বই পড়তে ভালোবাসতেন না। কখনো দেখা যেত আমবাগানে, আবার কখনো দেখা যেত জামরুল গাছের গোড়ায়।

পড়াশোনা

চার বছর বয়স থেকে তাঁর হাতেখড়ি হয়। পাঠশালায় উচ্চশিক্ষা সম্ভব নয়, তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের স্কুল। আর তাঁর শিক্ষা শুরু হয় বাবার তৈরি এম ই স্কুলে। ১৮৭২ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু রক্ত আমাশয়ের কারণে পড়াশোনায় বাঁধার সৃষ্টি হয়।

রাত জেগে পড়াশোনা করার ফলে এই রোগের সৃষ্টি হয়। আর তাই তিনি ফিরে যান গ্রামে। গ্রামে থাকাকালীন বাবার গ্রন্থাগার থেকে অনেক বই নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, যা তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছে। এ প্রসঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরীতে তিনি লিখেছেন, “স্কুলের শুকনো বইখাতা থেকে মুক্তি পেয়ে আমি সুযোগ পেয়েছিলাম নিজের পছন্দানুযায়ী বই পড়ার।” ১৭৮৪ সালে কলকাতায় ফিরে আসেন। এখানে এসে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন।

এখান থেকেই ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি মেট্রোপলিটন কলেজে ভর্তি হন। ১৮৮১ তে এখান থেকে এফ এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হন। এখান থেকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান।

এখান থেকে বি এসসি পাশ করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ডি এসসি ডিগ্রী লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন। গবেষণার বিষয় ছিল কপার ম্যাগনেসিয়াম শ্রেণীর সম্মিলিত সালফেটের সংযুক্তি পর্যবেক্ষণ। দু বছর পর এই গবেষণা সম্পন্ন করেন। পাশাপাশি পিএইচডি ও ডিএসসি ডিগ্রী লাভ করেন।

এই গবেষণায় শ্রেষ্ঠ হয়ে তিনি হোপ প্রাইজে মনোনীত হন। সারাজীবন তিনি পড়াশোনা করেছেন, তাই নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “আজো আমি জ্ঞানের অনুশীলন করিয়া থাকি আজীবন। আমি ছাত্রভাবেই আছি। পৃথিবীতে যত্ন কিছুসৎ চিন্তা আর উৎকৃষ্ট ভাব আছে, যত কিছুউদ্দীপনা সৃষ্টি করে এবং মানুষের হৃদয়ে প্রেরণা । দেয় তার সবই পুস্তকে নিহিত।”

কর্মজীবন

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, “প্রেসিডেন্সি কলে ২৭ বৎসরব্যাপী অধ্যাপনাকালে আমি বিশেষ করিয়া নিম্নতর শ্রেণীতেই অধ্যাপনার ভার গ্রহণ করিতাম।

হাই স্কুল হইতে ছেলেরা যখন প্রথম কলেজে পড়িতে আসে, তখনই তাহাদের মন যথার্থরূপে শিক্ষাগ্রহণের উপযোগী থাকে।...জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর সেসনের আরম্ভে এই তিনমাস,—অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন এই তিন মূল পদার্থ এবং তজ্জাত মিশ্র পদার্থগুলির আলোচনা হয়।

আমি আমার ছাত্রদিগকে রসায়নের ইতিহাস, অক্সিনের আবিষ্কার, প্রিস্টলে, লাভোয়াসিয়ার এবং শীলের আবিষ্কারকাহিনী এবং তাঁহাদের পরস্পরের কৃতিত্ব এই সব শিখাই, তারপর অকসাইডস অব নাইট্রোজেন, পরমাণুতত্ত্ব প্রভৃতি বিশ্লেষণ করি এবং ডাল্টনের আবিষ্কার কাহিনী বলি।

সংক্ষেপে আমি প্রথম হইতেই ছাত্রদের রসায়নজ্ঞানকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিতে চেষ্টা করি।” প্রায় ২৪ বছর অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তাঁর পড়ানোর ভাষা ছিল বাংলা। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল রসায়ন।

বাঙালিদের ব্যবসায় অনীহা পর্যবেক্ষণ করার জন্য নিজ উদ্যোগে ১৮৯২ সালে বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই কারখানা ১৯০১ সালে কলকাতার মানিকতলায় স্থানান্তরিত করা হয়।

অবদান

  • নিজের বাসভবনে দেশীয় ভেষজ নিয়ে গবেষণার জন্য তৈরি করেন বেঙ্গল কেমিক্যাল।
  • ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মার্কারি (I) নাইট্রেট (মারকিউরাস নাইট্রাইট) [Hg2(NO2)
  • ১২ টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন।
  • ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে পিতার নামে আর,কে,বি,কে হরিশ্চন্দ্র স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

সম্মাননা

  • শিক্ষকতার জন্য আচার্য হিসেবে ভূষিত হন।
  • ইংল্যান্ড থেকে সি আই ই লাভ করেন।
  • ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট পান, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে মহীশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। অসহযােগ আন্দোলনের সময়ে প্রচারের উদ্যোক্তাদের অন্যতম প্রধান ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, ‘আজ তোমরা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধাবে, কাল চীনের সঙ্গে। এই তোমাদের যুদ্ধ মিসরের সঙ্গে ওই আফগানদের সঙ্গে আর তার খেসারত দিতে হবে ভারতবাসী- সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের।’

গ্রন্থ সমূহ

তিনি মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন। যেমন তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী অন্যদিকে ছিলেন সাহিত্যিক। তাঁর লেখা গ্রন্থ গুলি হল -

  • A history of Hindu chemistry for the earliest times of the middle of sixteenth century
  • হিন্দু রসায়ন বিদ্যাসরল প্রাণিবিজ্ঞান
  • দ্য হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি
  • বাঙ্গালী মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার
  • India before and after the sepoy mutiny

মৃত্যু

প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১৯৪৪ খ্রিঃ ১৬ ই জুন ৮৩ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।

উল্লেখযোগ্য তথ্য

  • নিজের জন্য ৪০ টাকা রেখে, বাকি সবটাই দান করে দিতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা দান করেন।
  • শৈশবের ডাক নাম ছিল ফুনু। ছোটো থেকেই খুব দূরন্ত ছিলেন। প্রফুল্ল চন্দ্র রাত তিনটের সময় উঠে পড়তে বসতেন। ওই সময়টাই তাঁর কাছে ছিল উপযুক্ত সময়। কারণ তখন কোনো কোলাহল থাকতনা। একদিন রাতে পড়ার সময় দেখে প্রদীপে তেল নেই। কিন্তু এই সময়টা তো নষ্ট করা যাবেনা। তাই তিনি সুগন্ধি তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে পড়াশোনা শেষ করেন।
  • প্রফুল্ল চন্দ্র রায় পছন্দ করতেন নিউটনের জীবনী, গ্যালিলিওর জীবনকাহিনি, শেক্সপিয়ারের নাটক।
  • প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পোশাক ছিল খুবই সাদামাটা। সাধারন ধুতির সাথে কালো কোট পড়তেন। চুল দাড়ি কাটার কথা মনেই থাকতনা।
  • সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, নীলরতন ধর, পুলিন বিহারী সরকার, রসিকলাল দত্ত, মেঘনাদ সাহা, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বিজ্ঞানী কুদরত-ই খুদা, হেমেন্দ্র কুমার সেন, বিমান বিহারী দে, প্রিয়দা ভঞ্জন রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায়, জ্ঞানেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্র লাল দে, প্রফুল্ল কুমার বসু, বীরেশ চন্দ্র গুহ, অসীমা চ্যাটার্জি এইসব জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ছাত্র ছিলেন।
  • প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অনেক ছাত্রই বিজ্ঞানী হয়েছেন আর তাই প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে বলা হত, বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী।

প্রফুল্ল চন্দ্র রায় - প্রশ্নোত্তর (FAQ)

১) প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কোথায় কত খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন?

উ:- ২ আগস্ট, ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ, রাড়ূলী পাইকগাছা খুলনা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি (বর্তমান বাংলাদেশ) ব্রিটিশ রাজ।

২) প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পিতা ও মাতার নাম কী?

উ:- হরিশচন্দ্র রায় ও ভুবনমোহিনী দেবী।

৩) প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মৃত্যু কত খ্রিস্টাব্দে?

উ:- ১৬ জুন ১৯৪৪ (বয়স ৮২)।

শেষকথা

অসংখ্য ধন্যবাদ BongHood.Com এর মাধ্যমে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এর জীবনী (Prafulla Chandra Roy Biography in Bengali) টি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য। আরও নিত্যনতুন ও জানা অজানা তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইট টি ভিজিট করবেন এবং আমাদের সাথে থাকবেন। আমরা আমাদের সাইটে পোস্ট গুলি নিয়মিত আপডেট করি। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url