মাদার তেরেসা জীবনী | Mother Teresa Biography in Bengali

Mother Teresa Biography in Bengali

Mother Teresa Biography in Bengali 

“কেবল সেবা নয়, মানুষকে দাও তোমার হৃদয়
হৃদয়হীন সেবা নয়, তারা চায় তোমার অন্তরের স্পর্শ।”

ই কথাটা যিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন, তিনিই হলেন মাদার তেরেসা (Mother Teresa)। তিনি হলেন জীবন্ত ঈশ্বর। ভোগে নয়, ত্যাগ আর ভালোবাসার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করেছেন। আর তাই তো তিনি সকলের মাদার। রইল মাদার তেরেসার জীবনী (Mother Teresa Biography in Bengali)

মাদার তেরেসার সংক্ষিপ্ত জীবনী

আসল নাম (Real Name) অ্যাগনিস গঞ্জা বোজাঝিউ।
জন্ম (Birthday) ২৬শে আগস্ট ১৯১০।
জন্মস্থান (Birth Place) ইউস্কুপ, অটোম্যান সাম্রাজ্য।
মৃত্যু (Death) ৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৭।
পিতা ও মাতা (Parents) নিকোলাস বোজাকসহিউ ও দ্রানা বয়াজু

মাদার তেরেসার জন্ম | Birthday of Mother Teresa

১৯১০ সালের ২৬শে আগষ্ট যুগোস্লোভিয়ার স্কোপিয়ে শহরে এক কৃষক পরিবারে মেরি টেরেজা বোজাঝিউ জন্মগ্রহণ করেন। 

মাদার তেরেসার পিতা ও মাতা | Parents

তিনি নিকোলাস বোজাকসহিউ ও দ্রানা বয়াজুর কনিষ্ঠ সন্তান। অ্যাগনেসরা ছিলেন দুই বোন ও এক ভাই। তাঁর আর এক বোন জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। আর তাই নিজেকে সবসময় আড়ালে রাখতেন। এরপর মাত্র ৮ বছর বয়সে বাবাকে হারান। এরপর তাঁর মা ক্যাথলিক আদর্শে লালন-পালন করেন। 

মাদার তেরেসার পড়াশোনা | Education Life of Mother Teresa

স্থানীয় সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি পিতৃভূমিতেই সেন্ট মার্গারেট স্কুলে মাত্র তিনটি শিশুকে নিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন।

মাদার তেরেসার কর্মজীবন | Career

জন্মসূত্রে আলবানিয় জাতি হওয়ায় মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে সন্ন্যাসিনীর ব্রত নিয়ে  গৃহত্যাগ করে ভারতে আসেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। সাত-সাতটা সপ্তাহ জাহাজে কাটিয়ে ১৯২৮-এর শেষ দিকে তখন ভারতে শীত, সেই সময়ে নামলেন খিদিরপুর ডকে।

পরনে ছিল কালো গাউন, গলায় ক্রস, মাথায় বাঁধা কালো রুমাল, হাতে কালো ব্যাগ আর টিনের বক্স। এখানে এসে প্রথমে দার্জিলিং এ স্কুল শিক্ষিকা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ততদিনে শিখে নিয়েছিলেন বাংলা ভাষা। এরপর  ১৯৩১ এ কলকাতায় এসে এন্টালিতে সেন্ট মেরিজ হাইস্কুলে ভুগোল শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন।

তারপর লরেটো স্কুলেও কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ভারতের  নাগরিকত্ব পান। ভারতে থাকাতে তিনি দেখতে পান পঞ্চাশের মন্বন্তর, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। যা তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে। আর তাই স্কুলের কাজ ছেড়ে দেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি ভেতর থেকে সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার ডাক শুনতে পেলাম এবং বস্তির অতি দরিদ্র মানুষের সেবা করলেই

খ্রিষ্টকে সেবা করা হবে বুঝতে পারলাম।’ আর তাই তাঁর রান্নার লোক চারুর মাকে সাথে করে নিয়ে চলে এলেন ১৪ নম্বর ক্রিক লেনের বাড়ির তিন তলার ঘরে। ঘরে ছিল লোহার খাট। সাত আটজন সঙ্গিনী। পুরো তিনতলাটা নিজের করে পেয়েছিলেন। প্রতি দিন রাতে ওই তিনতলার মেঝে মুছতেন।

এরপরই তিনি মানুষ সেবায় যোগদান করেন। তখন তিনি পড়তে থাকেন নীল পাড় দেওয়া একটা সাদা শাড়ি। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘ডায়োসিসান ধর্মপ্রচারকদের সংঘ' তৈরি করেন, যা বর্তমানে ‘মিশনারিস অফ চ্যারিটি’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন।

দুঃস্থ হতদরিদ্র মানুষদের চিকিৎসার জন্য কলকাতার কালীঘাটের হিন্দু মন্দিরকে ‘কালীঘাট হোম ফর দ্যা ডাইং’এ রূপান্তরিত করেন, যার নাম দেন ‘নির্মল হৃদয়’।এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই চিকিৎসা পেতেন। ছিলনা কোনো ভেদাভেদ।এরপর কুষ্ঠরোগীদের সেবার জন্য টিটাগড়ে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম দেন ‘শান্তি নগর’।

অনাথ-অবহেলিত শিশুদের জন্য ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ‘নির্মল শিশু ভবন’ স্থাপন করেন। এরপর একে একে তৈরী করেন ‘প্রেমদান’, ‘দয়াদান’ প্রভৃতি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাঁর কাজের প্রশংসা করেন। এরপরই তিনি কলকাতার ‘স্বর্গীয় টেরিজা’ (Blessed Teresa of Calcutta) নামে পরিচিত হন।

এক ব্যক্তি মাদার তেরেসা (Mother Teresa) সম্পর্কে বলেছেন, “কলকাতায় দারিদ্র্য বেশি। অত্যাচার, অবিচারের মধ্যে গিয়ে ওই প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনযাত্রাকে ছোঁয়া—এটা এর আগে কেউ করেনি। মানুষ তা বুঝেওছিল। তাই মাদারকে মানুষ আলাদাভাবে শ্রদ্ধা, সম্মান জানিয়েছে।

কোথাও একটা বোধশক্তি এ ব্যাপারে কাজ করছিল। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসেব করেননি মাদার। ভাবেননি, তাঁর এই কাজের মাধ্যমে সমাজ কতটা পাল্টাবে। এরও তো একটা আলাদা মূল্য আছে!” তবে মাদার তেরেসা যে সবসময় প্রশংসা পেয়েছেন তা কিন্তু নয়।

তাঁকে সইতে হয়েছে সমালোচনা। ধর্মযাজকের পোশাক ত্যাগ করার জন্য সমালোচিত হয়েছেন, সমালোচিত হয়েছেন গর্ভপাত নিয়ে, সমালোচিত হয়েছেন তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে। তবে তিনি দমে যাননি, তিনি নিজের কাজ নিজের মত করে চালিয়ে গেছেন।

মাদার তেরেসার পুরস্কার সমূহ | Mother Teresa Prizes

মাদার তেরেসার সেবা ধর্ম-কর্ম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আর তাই তো তিনি ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম মহিলা হিসাবে ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ (১৯৭৯) পান। তিনি পেয়েছেন ‘ভারতরত্ন’ পুরস্কার। এছাড়াও পেয়েছেন, ‘পদ্মশ্রী পুরস্কার’(১৯৬২), ‘নেহেরু পুরস্কার’, ‘বালজান পুরস্কার’, ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রীডম’। বিশ্বভারতী থেকে ‘দেশিকত্তম উপাধি’ পান।

মাদার তেরেসার মৃত্যু | Mother Teresa Death

১৯৮৩ সালে রোম সফরের সময় হার্ট অ্যাটাক হয়। এরপর ১৯৮৯ সালে পেসমেকার স্থাপন করা হয়। ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হন। এরপর ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে পড়ে গিয়ে কলার বোন ভেঙে ফেলেন।  তারপর আগস্টে হৃদপিন্ডের অবনতি ঘটে। ১৯৯৭ সালের ১৩ই মার্চ মিশনারিস অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ ত্যাগ করেন। এরপর ১৯৯৭ সালে ৫ই সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। 

মাদার তেরেসার বাণী - Mother Teresa's Quotes in Bengali

‘‘বিশ্ব শুধু রুটির জন্য ক্ষুধিত নয়, প্রেমের জন্যও বটে৷’

আমি ঈশ্বরের হাতের একটি ছোট পেন্সিল যা দ্বারা ঈশ্বর পৃথিবীতে ভালোবাসার চিঠি লিখছেন।

স্বর্গ ঠিক কেমন দেখতে জানি না, কিন্তু এটা জানি, মৃত্যুর সময় এলে ঈশ্বর আমাদের বিচার করেন। তুমি জীবনে কী কী ভালো কাজ করেছো, এটা তিনি জিগগেস করেন না। বরং জিগগেস করেন, তুমি মানুষকে কতটা ভালোবাসা দিতে পেরেছো?

যতক্ষণ পর্যন্ত নিঃস্বার্থভাবে কাউকে সাহায্য না করেছ ততক্ষণ পর্যন্ত জীবনে কিছুই করতে পারনি।

উল্লেখযোগ্য তথ্য - Unknown Facts about Mother Teresa

  • ১৯৩১ সালে সন্ন্যাসী হওয়ার সময় নিজের জন্য তেরেসা (Teresa) নামটি পছন্দ করেন। 
  • তিনি নোবেলপ্রাপ্তি উপলক্ষে সম্মানভোজ প্রত্যাখ্যান করে পুরস্কারের বদলে চেয়েছিলেন ১ লক্ষ ৯২ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে যাতে দরিদ্র মানুষের সেবা করা যায়। 
  • তিনি অলৌকিক ভাবে এক মহিলার টিউমার নিরাময় করেছিলেন। 
  • মাদার তেরেসার কর্মকাণ্ড শুধু ভারতে নয়, রোম, তানজানিয়া, অস্ট্রিয়া, এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকা সহ নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এইসব দেশে তাঁর চ্যারিটি গড়ে ওঠে। 
  • ২০১৬ এর ৪ঠা সেপ্টেম্বর রোমের পোপ মাদার টেরেজাকে ‘সন্ত’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁর অলৌকিক কর্মকাণ্ডের জন্য এই সম্মান দেওয়া হয়। তিনি তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা মানুষের টিউমার সারিয়েছেন।
  • প্রথম দিকে সবার দোরে দোরে খাবার ও আশ্রয়স্থল ভিক্ষা করে বেড়িয়ে ছিলেন। তাঁর মনে হয়ছিল আগের জীবনে ফিরে যাওয়ার।

    এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর ডায়েরীতে লিখেছেন, “ঈশ্বর চান যে, আমি এক বন্ধনমুক্ত সন্ন্যাসিনীই থাকি, ক্রুশ চিহ্নের দীনতা আমাকে আবৃত করে থাক। আজ একটা ভাল শিক্ষা পেলাম। গরিব লোকদের দারিদ্র্য কত কষ্টকর। যখন বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি, হেঁটে হেঁটে আমার গা-হাত-পা ব্যথা হয়ে যেত। আমি ভেবে দেখলাম, বাসস্থান, খাদ্য, সাহায্য কোথায় পাবে, তার চেষ্টাতেই গরিব মানুষদের দেহ এবং আত্মা কী যন্ত্রণা ভোগ করে। তখন প্রবল হয়ে উঠলো লোভ। লরেটোর প্রাসাদোপম গৃহগুলির কথা মনে উদয় হল। কে যেন আমায় লোভ দেখাতে লাগল, 'একবার মুখ ফুটে চাইলেই, সে-সবই আবার ফিরে পাব।' আমার প্রভু, নিজের ইচ্ছায়, তোমার প্রতি প্রেমে, আমি তাই করতে চাই, যা আমাকে দিয়ে তুমি করাতে চাও। এক বিন্দু অশ্রুও আমার চোখ থেকে আমি পড়তে দিলাম না'

  • তিনি মিশনারিজ চ্যারিটি স্থাপন করে ক্ষুধার্ত, নগ্ন, গৃহহীন, আর্ত, নিপীড়িত, সর্বহারা, সমাজবর্জিত মানুষদের পাশে দাঁড়ান। । 
  • ১৯২৮ এ নিজের দেশ ছাড়ার পর ১৯৯১ সালে আবার সেখানে যান মিশনারিজ অব চ্যারিট স্থাপন করেন। 
  • মাদার তেরেসা পাঁচটি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, আলবেনিয়ান ও সার্বিয়ান। 
  • কলকাতায় রয়েছে 'The Mother House Of The Missionaries Of Charity'। এটা তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে মিউজিয়াম। 

সত্যি মানুষ ঈশ্বরের দূত। ঈশ্বর মানুষকে দূত হিসেবে পাঠায়, আর তাঁর সার্থক উদাহরণ হল মাদার তেরেসা (Mother Teresa)। একজন বিদেশীনী হয়ে সারা ভারতের জন্য নিজের হৃদয় বিলিয়ে দিয়েছেন। শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বেও তাঁর জয়জয়কার। আর তাই তো তিনি বিশ্বমাতা।

তিনি নির্দিষ্ট একজনের মা নন, তিনি মুচি-মেথরেরও যেমন মা, তিনি সমাজের উচ্চবর্ণেরও  মা। যেমন হিন্দুর মা, তেমনই মুসলমানের মা। আর তাই তো আজও পর্যন্ত সবাই তাঁর নাম উচ্চারণের আগে  'মাদার' শব্দটি ব্যক্ত করে। যেসব অনাথ মানুষরা মা বলতে পারেনা কাউকে, সেই সব অনাথের কাছে ক্ষণিকের জন্য মা। 

মাদার তেরেসা জীবনী (প্রশ্নোত্তর) - Mother Teresa Biography in Bengali (FAQ)

মাদার তেরেসা কত খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন?

২৬ আগস্ট ১৯১০।

মাদার তেরেসার পিতার নাম কি?

নিকোলাস বোজাকসহিউ

মাদার তেরেসা কে?

আলবেনীয় বংশ উদ্ভূত ভারতীয় ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী এবং ধর্মপ্রচারক ।

মাদার তেরেসার মৃত্যু কবে হয়?

৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সালে।

মাদার তেরেসা কবে ভারতে আসেন?

মাদার তেরেসা ১৯২৮ সালে ভারতে আসেন।

মাদার তেরেসা কবে ভারতরত্ন পান?

১৯৮০ সালে।

... ...

শেষকথা

অসংখ্য ধন্যবাদ BongHood.Com এর মাধ্যমে মাদার তেরেসা জীবনী (Mother Teresa Biography in Bengali) টি শেষ অব্ধি পড়ার জন্য। আরও নিত্যনতুন তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইট টি ভিজিট করবেন এবং আমাদের সাথে থাকবেন। আমরা পোস্ট গুলি নিয়মিত আপডেট করে থাকি। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url