শরীরে আয়রনের অভাব বুঝবেন যে ১৯ টি লক্ষণের মাধ্যমে
লৌহ বা আয়রন আমাদের শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজন। এই খনিজ উপাদান রক্তের লোহিত রক্তকণিকার কাঁচামাল। এই যৌগ না থাকলে শরীরে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হতে পারেনা। আর তাই এর অভাবে আমাদের শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। তবে আয়রন যে শুধু রক্তকণিকা তিনি তৈরি করে তা কিন্তু নয়, দেহের শক্তি উৎপাদন থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের স্নায়ুপ্রবাহ সবটাই এর উপর নির্ভরশীল। আর তাই দেহে যখন আয়রনের ঘাটতি হয়, তখন রক্তশূন্যতা দেখা যায়। ডাক্তারি ভাষায় একে বলে অ্যানিমিয়া। এখন প্রায় সকলেরই এই সমস্যা দেখা যাচ্ছে।
সমগ্র ভারতে ৫৩.২ শতাংশ মহিলা এবং ২১.৭ শতাংশ পুরুষ রক্তাল্পতায় জর্জরিত। আয়রনের অভাবে শরীরে নানান রকম সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এই সমস্যায় সবথেকে বেশি নারীরা সম্মুখীন হয়। আয়রন কম থাকার কারণে হিমোগ্লোবিন তৈরি হয়না আর হিমোগ্লোবিন না থাকলে শরীরের পেশীগুলি দূর্বল হয়ে যায়। শুধু তাই নয় ত্বক, চুল এবং নখেও এর প্রভাব পড়ে। কিন্তু অনেকেই বুঝতে পারেনা, তাদের দেহে আদৌও এই সমস্যা রয়েছে কিনা। আসুন জেনে নেওয়া যাক , কীভাবে বুঝবেন আপনিও এই সমস্যার সম্মুখীন?
আয়রনের ঘাটতি হলে কী কী উপসর্গ দেখা যায় —
- শারীরিক দুর্বলতা :- আয়রনের ঘাটতি দেখা দিলেই শরীরে ক্লান্তি বোধ লক্ষ্য করা যায়। আয়রনের অভাবে শরীরের সব জায়গায় অক্সিজেন পৌঁছায় না, তাই ক্লান্তি অনুভব হয়।
- মাথাব্যথা/ মাথাঘোরা :- আয়রনের অভাবে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব দেখা যায়, আর তখনই মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা হয়।
- মনোযোগ কমে যাওয়া।
- স্মরণশক্তির ঘাটতি :- দেহে আয়রনের মাত্রা কমে গেলে স্মৃতি শক্তি লোপ পায়।
- মাংসপেশিতে ব্যাথা।
- চুল পড়ে যাওয়া :- অতিরিক্ত চুল পড়ার সমস্যাকেও এই তালিকায় রাখা হয়।
- বুক ধরফর করা :- হঠাৎ করে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া আয়রনের ঘাটতির মূল লক্ষণ।
- শ্বাসকষ্ট :- অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠছেন, একটু হাঁটলেই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, তখনই বুঝতে হবে আয়রনের অভাব।
- স্থূলতা।
- হাত পা অসাড় হয়ে যাওয়া।
- নখ বেঁকে যাওয়া:- নখ দেখেও বোঝা যায় আয়রনের ঘাটতি আছে। দেখবেন নখ নরম হয়ে গেছে বারবার ভেঙে যাচ্ছে, তখনই বুঝতে হবে আয়রনের ঘাটতি রয়েছে।
- জিভ ফোলা :- হঠাৎ যদি জিভ ফুলে যায়, তখন বুঝতে হবে আয়রনের ঘাটতির কারণে হচ্ছে।
- হাত পা ঠান্ডা :- অনেকেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার সমস্যায় ভোগেন। এটাও আয়রনের ঘাটতি।
- ত্বক ফ্যাকাশে হওয়া :- আয়রনের ঘাটতি দেখা দিলে ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যায়। দেহের কোষগুলিতে রক্ত সমান ভাবে রক্ত পৌঁছায় না, তাই এমনটা দেখা যায়।
- ঘনঘন জ্বর :- হঠাৎ করেই আপনার ঘনঘন জ্বর আসছে, সর্দি কাশি হচ্ছে। কিন্তু আপনার ঠান্ডা লাগেনি। তখনই বুঝতে হবে এটা আয়রনের অভাবে।
- মুখে ক্ষত :- আয়রনের অভাবে মুখে ক্ষত দেখা যায়। মুখের ভিতর শুকিয়ে যায়, মুখের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতর সৃষ্টি হয়, জিহ্বা ও গালের ভেতরে জ্বালাপোড়া অনুভব হয়।
- থাইরয়েডের সমস্যা :- আয়রনের অভাবে থাইরয়েডের সমস্যা দেখা যায়। পরিশ্রম করার ক্ষমতা কমে যায়, তাপমাত্রা বেড়ে যায়, ওজন বেড়ে যায়, আঘাত ছাড়ায় ব্যাথা অনুভব হয়।
- পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা :- আয়রনের ঘাটতি থাকলে পেট ব্যথা, বদহজম, পুষ্টির অভাব লক্ষ্য করা যায়।
- অখাদ্য খাবার খাওয়ার ইচ্ছা :- মাটি, চক পাউডার, কাদা, ময়লা কাগজ ইত্যাদি খাওয়ার ইচ্ছে হয়।
আয়রনের ঘাটতি কেন হয়?
- দীর্ঘদিন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন করা, পাকস্থলীর সার্জারি, অর্শ বা পাইলসের সমস্যা, কৃমি সংক্রমণ, দীর্ঘদিন ব্যথার ওষুধ সেবন করলে আয়রনের ঘাটতি দেখা যায়।
- ঋতুস্রাবের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত হলে রক্তাল্পতা দেখা যায়।
- শরীরে আয়রন, ভিটামিন বি এবং ফোলিক অ্যাসিডের ঘাটতি হলে রক্তশূন্যতা দেখা যায়।
প্রতিরোধ
- আয়রনের ঘাটতি হলে পালং এবং অন্যান্য শাকসবজি, ব্রকলি, স্যামন মাছ, মুরগির মাংস, মাছ, কড়াইশুটি, সামুদ্রিক খাবার, বিনস, সব রকমের ডাল, শুকনো ফল, ডার্ক চকোলেট প্রভৃতি খেতে হবে।
- ফলের তালিকায় রাখতে হবে, পেঁপে, লেবু, স্ট্রবেরি, কমলালেবু, ক্যাপসিকাম, তরমুজ।
- আয়রনের ঘাটতি হলে সয়াবিন, সূর্যমুখী তেল খাওয়া চলবে না।
- খুব বাড়াবাড়ি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, যা বলবে সেটাই মেনে চলুন।
- খুব বেশি শরীর চর্চা করবেন না। অল্প অল্প করে ব্যায়াম করুন।
- একটানা কাজ করবেন না, বিশ্রাম নিয়ে কাজ করুন।
- বীটে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ শর্করা, বিটের পাতায় রয়েছে আয়রন, তাই বিট খাওয়ার থেকে বিটের পাতা খাওয়া বেশি উপকারী।
- জাম খেলে রক্ত বাড়ে। জাম আর আমলার রস একসাথে খেলে রক্ত বাড়ে।
- পেস্তা ফলের মধ্যে রয়েছে ৩০ রকম ভিটামিন, এতে রয়েছে আয়রন। আর তাই রোজ সকালে ৪ টে করে পেস্তা খেতে পারেন।
- বেদানাতে রয়েছে ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ভিটামিন সি, আয়রন। একগ্লাস ইষদুষ্ণ দুধের সঙ্গে বেদানা মিশিয়ে খেলে শরীরে হিমোগ্লোবিন বাড়বে।
- খেজুর ও কিশমিশ রক্ত গঠনে বেশ সহায়ক। তাই ব্রেকফাস্টের আগে ৩ টি খেজুর আর ৫ টি কিশমিশ যদি খেতে পারেন তাহলে খুবই উপকার হবে।
- সজনে পাতাও রক্ত গঠনে সক্ষম। এই পাতায় রয়েছে আয়রন, ভিটামিন এ, সি এবং ম্যাগনেসিয়াম। তাই রোজ সকালে যদি এই পাতার গুড়ো খাওয়া হয় তাহলে সমস্যার সমাধান হবে।
- ডুমুরও রক্ত গঠনে সাহায্য করে, ডুমুরে রয়েছে ভিটামিন এ, বি ১, বি ২, ক্যালশিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্লোরিন। রোজ রাতে ডুমুর জলে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকালে খান, এতে হিমোগ্লোবিন বাড়বে।
- তিলের বীজে থাকে আয়রন, কপার, জিঙ্ক, সেলেনিয়াম, ভিটামিন বি ৬. ফোলেট, এবং ভিটামিন ই। তাই তিলের লাড্ডু, নাড়ু খেতে পারেন।
প্রতিদিন মানুষের শরীরে কত পরিমাণ আয়রন প্রয়োজন
৪ থেকে ৮ বছর বয়সের বাচ্চাদের প্রতিদিন ১০ মিলিগ্রাম প্রয়োজন। ৯ থেকে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন ৮ মিলিগ্রাম প্রয়োজন। ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের প্রতিদিন 18 মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন। পুরুষদের দিনে মাত্র 8 মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন।
শরীরে কেন আয়রন প্রয়োজন
- হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে আয়রনের প্রয়োজন হয়। হিমোগ্লোবিন শরীরে অক্সিজেন পৌঁছাতে সাহায্য করে।
- প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বিভিন্ন সংক্রমণের সাথে লড়াই করার জন্য শরীরে প্রয়োজন মত আয়রন দরকার।
- আয়রন পেশী এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেন বহন করে যা শরীরের কার্যকারিতা বাড়ায়।
- গর্ভাবস্থায় আয়রনের ঘাটতি হলে প্রিম্যাচিওর বেবির জন্ম হয়। ওজন কম, শিশুদের মধ্যে প্রতিবন্ধী আচরণ, মেধার অভাব ইত্যাদি দেখা যায়। তাই রক্তের পরিমাণ সঠিক রাখতে হবে।
- আয়রনের ফলে ঘুম ভালো হয়।
লক্ষণীয় বিষয়
- অন্যদিকে শরীরে আয়রন বেশি হয়ে গেলেও সমস্যা দেখা যায়। রোগীদের ডায়াবিটিস, যৌনতায় অনিহা, পুরুষত্বহীনতা, হার্ট ফেলিওর, লিভার ফেলিওর ইত্যাদি হতে দেখা যায়।
- শুধুমাত্র আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খেলেই হবেনা, এমন খাবার খেতে হবে যা শরীর শোষণ করতে পারে। কারণ সব আয়রন শরীর শোষণ করতে পারে না। তাই শাক ভাজা খাওয়ার সময়ে দু’ফোঁটা লেবুর রস দিয়ে খেলে এই আয়রন শরীর শোষণ করবে।
- অনেকেই আয়রনের ঘাটতি দূর করতে সাপ্লিমেন্ট খান, কিন্তু এই সাপ্লিমেন্টে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকে। পেটব্যথা, পেট খারাপের মতো বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।
- চা, কফি, দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য আয়রন শোষণে বাঁধার সৃষ্টি করে, তাই এই খাবার গুলি এড়িয়ে চলা ভালো।